জলেতে গিয়েছিলাম সই

মাসুম সায়ীদ:
১৩ আগস্ট ২০১৭, সকাল
আজিকার রোদ ঘুমিয়ে পড়িছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে…
বাদশাগঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখি দিগন্তজোড়া পানি আর পানি। গোলাটে মুখ ভার আকাশ। কাল সারারাত ছিল হাওর এক্সপ্রেসের জানালায় চাঁদ-মেঘের লুকোচুরি আর বৃষ্টির ছোঁয়াছুয়িতে মাখা। ভোরে মোহনগঞ্জ নামলাম তখনও আকাশের মেজাজ-মর্জি বোঝা যাচ্ছিল না। মোহনগঞ্জে জটলা পাকিয়ে লাভ কী। তার চেয়ে বরং নৌকার পাটাতনে পিঠ পাতি। দুটো অটোতে উঠলাম আটজন। বারোজনের দল। দলনেতা গণি ভাই আসতে পারেননি মায়ের অসুখের কারণে। তার আসনে এখন সালাউদ্দিন ভাই। সাথে মনির ভাই । পথ দেখাচ্ছেন বাহরম ভাই। মাঝি-নৌকা-বাবুর্চির ঠিকাদারও তিনিই। সালউদ্দিনভাই, মনির ভাই আর ইউসুফ ভাইরয়ে গেলেন বাজার সওদার জন্যÑ মাঝিমাল্লাসহ ষোল জনের তিনদিনের সকল রসদ নিয়েই ভাসাতে হবে নৌকা। নৌকাতেই খানাপিনা বিছানা।
বাদশাগঞ্জ বাজারের নামলাম। সামনেই ব্রিজ। ব্রিজ পার হয়েই দেখি অপূর্ব এক নৌকা। মজবুত ছই। তার ওপর একটা বর্ণীল সামিয়ানা। মৃদু ঢেউয়ে নৌকাটা দুলছে। যেন একটা রাজহংসী। দেখাতে হয় না আপনিই চোখে পড়ে। ব্যাগবোচকাসহ নৌকায় উঠলাম। দৃষ্টি মেললাম চারদিক। একদিকে আধডোবা গ্রাম বাকি তিনদিক পানি আর পানি। বেলা দশটা। রোদ নেই। পায়ের নিচে ঘোলাপানির পাথার। মাথার উপরে ঘোলা মেঘ।

মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল
ছইয়ের সামনের দিকটায় ব্যাগবোচকা রেখে ছোট্ট সিঁড়িটা বেয়ে উঠে পড়লাম ছইয়ের উপর। বসার জন্য দুই ধারে রেলিং দেয়া কাঠের বেঞ্চ । হঠাৎই মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামল। আমরা তাড়াহুড়া করে ব্যাগগুলো চালান করে দিলাম ভিতরে। এর মধ্যে একটা যাত্রীবাহী নৌকা এল। সাথে লেজের মতো পাঁচছয়টা ডিঙি। মাঝি বললেন, ‘ঐ দেখেন নৌকার বহর। হাটে আনছে বিক্রির জন্য।’ আজ বাদশাগঞ্জে নৌকার হাট। মনির ভাই ফুটেজ নিচ্ছিলেন এতক্ষণ। ছাতা মাথায় করে নেমে গেলেন নিচে। ছবি মাস্টার অভিজিৎ নন্দির হাতেও ক্যামেরা। নেমে গেলে সেও। আমিও দেরি না করে পিছু নিলাম তাদের। ব্রিজের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে। ছাতা মাথার পথচারিদের চোখে কৌতূহল। বৃষ্টি যেমন এসেছিল তেমনি ছেড়েও গেল। আমরা আর নৌকায় না ফিরে গেলাম বাজারের । অল্প কয়েকটা মুদিখানা। আর চায়ের স্টল। আমরা একটাচায়ের দোকানে ঢুকলাম। টিভিতে হিন্দি চ্যানেল চলছে। লোকজনে ঠাসা। আমাদেরও জায়গা হলা। লাল চায়ের বায়না দিলাম। চা এল কিন্তু ভিষণ কড়া।
আমরা নৌকা ঘাট পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম কলেজটার দিকে। কলেজ বন্ধ। কালেজের সামনে রাস্তা। আর রাস্তর পরেই পানি। একটা শিরিষ গাছের নিচে গুচ্ছকারে কয়েকটা ডিঙা। যেন পাপড়ির মেলা পদ্ম। কলেজ ভবনের দক্ষিণে কলকাকলী বিদ্যাপীঠ। একটা নৌকা এসে ভিড়ল বোঝাই যাত্রীনিয়ে। ফিরে দেখলাম দলনেতা চলে এসেছেন। একজনের হাতে মস্ত একটা রাজহাঁস। নৌকা ছাড়ার আগে বাবুর্চি চুলা জ্বালিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে ঠিকমতো কাজ করে কিনা? বাবুর্চি ইঙ্গিত করতেই মাঝির সহকারী নোঙর তুলল। শুরু হল জলে ভাসার জীবন।

ভরদুপুর
মেঘময়ূরীর ছায়ায় ছায়ায়
সেই যেসকাল বেলা একপশলা বৃষ্টি তারপর দিব্যি ভালো। বৃষ্টি না থাকলেও মেঘময়ূরী থাকল পেখম খুলে । আর তারই ছায়ায় ছায়ায় আমাদের রাজহংসী এগিয়ে চলছে পানি কেটে। চারিদিক পানিতে একাকার। তাই পথের কোন বাছবিচার নেই। হাল সোজা রেখে শুধু এগিয়ে যাওয়া। যাত্রা শুরু হয়েছিল টগাবিল থেকে। দেখতে দেখতে সেটা ছাড়িয়ে বাইনচাপড়া। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিল হিজল আর করচ। তাদের মাথায় মাথায় পাখনা মেলা পানকৌড়ি। আর হঠাৎ হঠাৎ দুএকটা গ্রাম। মরূদ্যানের মতো বিস্ময়কর কিন্তু বাস্তব। তবে বোঝাই যাচ্ছে আমরা যাচ্ছি সোজা পথে। হাওরের মাঝখান দিয়ে। সামনে অজানা অচেনা একটা গ্রাম। পুরোটাই প্রায় ডুবে গেছে। তীরে দাঁড়িয়ে ছোটবড় কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ দেখল আমাদের। কেউ এল প্রায় দৌড়ে। কী ভেবেছিল ওরা? পার হয়ে গেলাম গ্রামটা। জলজ ঘাস আর নলখাগড়া দেখা যায় এমন জলের উপর দিয়ে। হয়ত পেরিয়ে এলাম কোন জলে ডোবা পথ। একসময় এসে পড়লাম কুচকুচে কালো পানির রাজ্যে । কতটা গভীর হতে পারে জায়গাটা? ‘অনেক’ মাঝির ভাবলেশহীন জাবাব। এই তবে টাঙ্গুয়া! এখন ভরা বন্যা। তাই নদী-খাল, ধান চাষের ক্ষেত আর বিল সব একাকার হয়ে গেছে। এখন এ কেবলই পানির রাজ্যে। ততক্ষণে রান্না শেষ। কিš‘ নাওয়া শেষ না করে খাওয়া কিসের ? দলনেতা কোথাও নৌকাটা থামাতে বললেন গোসলের জন্য। উত্তর সীমানা ছুঁয়ে আমরা পার হলাম টাঙ্গুয়া । সামনে মেঘালয়ের পাহাড়। তার নিচে আমাদের সীমান্তবর্তী গ্রাম। প্রায় সীমান্তের কাছাকাছি এসে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হল। যাদের সাঁতার জানা তারা লাফিয়ে পড়ল। যারা সাঁতার জানে না তারা নামল লাইফ জ্যাকেট নিয়ে। একজন কেউ ডুব দিয়ে দেখার চেষ্টা করল মাটি কত দূর। দমে কুলাল না। তাই ও চেষ্টাও আর কেউ করল না। বহু দিন পড় আমার মাথায় কৈশরের একটা অভ্যাশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। নৌকার ছাদ থেকে আমি তীরের ফলার মতো ঢুকে গেলাম জলে।

পড়ন্ত বিকেল
নৌকা চলছে পাহাড়ের পাশে পাশে। নাওয়ার পর শুরু হল খাওয়া। এতক্ষণ আসছিলাম পাহাড়কে সামনে রেখে । এবার বায়ে রেখে। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় পেরুলাম ডাম্পের বাজার। টেকের ঘাটের চুনাপাথরের খনির দিনে এটা ছিল সরগরম এক বাজার। এখন টিকে আছে লাকমার পাথর আর ভারত থেকে আমদানিকৃত কয়লায়। টেকেরঘাট বাজারে নৌকা ভিড়ল বিকাল সোয়া ছয়টায়। মেঘালয়ের নীলা পাহাড়ের ভাজে ভাজে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। বুকে সন্ধ্যার মায়া। আমরা পড়িমড়ি করে ছুটলাম পাথর খনির পরিত্যাক্ত লেকটার দিকে। প্রায় একশ ফিটের মতো গভীর অথচ কী নিরিহ আর সাধারণ । যেন একটা ডোবা। এখানে বিপদটা ঘটে। দূর থেকে ঘুরতে আসা অজানা পথিক নেমে যায় পানিতে। আর ডুবে মরে। দিন কয়েক আগেই ঘটেছে এমন।

সন্ধ্যা
পহাড়ের ডাক
নন্দি এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আলো ফুরিয়ে যাবার আগে সে কাছের কয়েকটি টিলা আর দূরের মেঘালয়ের পাহাড়কে চায় একই ফ্রেমে। প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অভ্যাস তার। এখানেও করল তাই। আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিল সব থেকে উঁচু টিলাটার ধারে। দাঁড়াতে হল তার ইচ্ছে মতো। ফিরে এসে ফ্রেমটা যখন দেখলাম চোখ উঠে গেল কপালে। মেঘালয় আর আমাদের ছোট্ট টিলাটা যেন দুপাশ থেকে ক্রমশ নিচু হয়ে মিশে গেছে এক বিন্দুতে। আর সেই মিলমোহনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি! এই চোখের জন্যই নন্দি ফটোমাস্টার। আলো নিভে এল। আমরা হেঁটে হেঁটে গেলাম বড় চরা বাজারে এককাপ চা খাব বলে। ফিরলাম বৃষ্টি মাথায় করে।

১৪.০৮.২০১৭, ভোর
ঝুম বৃষ্টির রাত ছিল…
সারারাত বৃষ্টি পড়েছে এক টানা ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝিতে তা টের পাচ্ছিলাম । খুব ভোরে উঠে পড়লাম। চারদিক ফর্সা হতেই নেমে আসলাম রাস্তায়। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ডাম্পের বাজার অবদি। অনেকটা পথ হাঁটলাম একা একা। তারপর সাথী হল আরিফ ভাই আর হাসানুর ভাই। আহ! কী ভারী আর অনর্গল বর্ষণ। এক পাশে সবুজ পাহাড় । অন্য পাশে পানি আর পানি। পেটে টান পড়লে খেয়াল হল সময় দেখার। সাড়ে আট। বাজারের এক হোটেলে ঢুকলাম গরম পরটার গন্ধে। অন্যরা ঘুমাচ্ছে ঘুমোক। একজন মাঝি হাওর থেকে ফিরলেন মাছ নিয়ে। বড় বড় সরপুটি। কিনে ফেললাম জনপ্রতি একটা। সাড়ে নয়টার দিকে বৃষ্টি ছুট দিলে ঝলমল করে উঠল চারদিক। ঘুম ভাঙল সবার। নাস্তাও হল। তারপর দল ধরে বের হলাম লামাক ঝর্না দেখতে। ফিরতে ফিরতে বেলা বারোটা। নৌকার বাঁধন খোলা হল। আমরা চললাম যাদুকাটা নদীর তীরে বারেক টিলার উদ্দেশ্যে। এরই মধ্যে জানা গেল পানিতে একাকার সুনামগঞ্জের চারদিক। আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে আসার পথেই। সে বন্দোবস্ত হল নৌকায় বসেই।

দুপুর রোদে
পথ ভুলে ঘোরা পথে
মাঝি এই পথে আসেন কম। পথ সহজ করতে সোজা হাওরের ভিতর দিয়ে চালিয়ে দিলেন নৌকা। এটা একটা অগভীর বিল। প্রচুর লাল পদ্মের। পদ্মবনের মাঝ দিয়েই তৈরি হয়েছে নাওধারা। কিছু দুূর যেতেই সামনে পড়ল গ্রাম। বলাবাহুল্য পানিতে ডোবা। বিদ্যুতের তারগুলো ছিড়ে একাকার। নৌকার ছাদের ছামিয়ানা খুলে ফেলতে হল। তারপর যেখানে মোড় নেয় দরকার ছিল সেখানে মোড় না নিয়ে চলে গেলেন সোজা। তারপর সামনে পড়ল একটা গ্রাম ফিরতে হল আমাদের। তারপরও আবারও একটা গ্রাম। নাম জিজ্ঞাসা করার কেউ নাই ধারের কাছে। অবশেষে বিল শেষে একটা খাল ধরে পড়া গেল নদীতে। নদীটাও অগভীর। মাঝে মাঝেই ঠেকে ঠেকে যাচ্ছিল। ঢলের পানিতে একাকার বলে কোনদিকে গভীর আর কোথায় চরা বোঝা মুশকিল। নদীর জলে মাছ ধরার উম্মাদনা। ক্ষেতের সব ধান তলিয়ে গেছে বলেই হয়ত। নৌকা ঠেকে গেল কয়েক বার। পনিতে নেমে ঠেলেঠুলে নামাতে হল অনেক কষ্টে। নৌকা নামাতে যারা নামে তাদের টেনে নৌকা ওঠানোর দৃশ্যটা দেখবার মতো হয়। একবার আমি নামিনি। শুনলাম সাগর ভাই চিৎকার করে বলছে বোয়াল মাছটা ধরে নৌকায় তোল। আমি ভাবলাম মস্তবড় বোয়াল মাছ হয়তো কেনা হয়েছে । দৌড়ে গিয়ে দেখলাম কয়েকজন মিলে রবিন ভাইকে টেনে তুলছে নৌকায়। তার ধবধবে সাদা শরীরটা দেখতে বোয়াল মাছের মতোই বটে। আর রবিন ভাইও কী সুন্দর খুশি মন্তব্যটা শুনে। বোয়াল মাছ বলে কথা!

নীল সাদায় জড়াজড়ি
আহা! আকাশের কী রঙ! মাঝে মাঝে সাদা মেঘ। শরৎ বাবু জানান দিলেন আমি এসে গেছি। ওদিকে মেঘালায়ের পাহাড় সদ্য স্নান করা এলোচুলের নারী। উজ্জ্বল রোদ, নীল আকাশ, নীল পাহাড় আর নদীর বুকে পাহাড়ী ঢলের পেড়ামাটি জল, জলের বুকে সচল জীবন। বালি আর পথর কুড়ানি, মাছ শিকারী, আর গ্রাম্য বালক-বালিকার উছল জীবন বাঁধা পড়ছিল ফ্রেমের ভিতর বারবার। কখনো ক্যামেরায় আবার কখনো মনে।

উজ্জ্বল বিকাল
যাদুকাটা খাল বেয়ে আমরা যখন যাদুকাটা নদীতে পড়লাম তখন বিকাল সোয়া চারটা। নৌকা ভিড়ল শিমুল বনের উজানে। দেশের একমাত্র শিমুল বাগান এখানে। কেউ নামল নাইতে। কেউ বসেছে ভাতের থালা নিয়ে। আর নন্দি গেল ক্যামেরা হাতে শিমুল বাগানে। ফিরল আসাধারণ দুটো ছবি নিয়ে। একটা ছবি তার সেলফেনে তোলা নদীর বাঁকা তীর যেন পরে আছে মালা। মালাটা নৌকার। প্যান করে তোলা। আর একটা অসাধারণ এক মুহূর্তের ছবি। দ্জুন প্রবীণ শিমুল গাছের তলে ঘাসের উপর নামাজে দাঁড়িয়ে। পড়ন্ত বিকেলের আলো তাদের চোখেমুখে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি আর উঠেছিও ভোরে তাই আমি ছিলাম তন্দ্রাচ্ছন্ন। ছবি দুটো দেখে তন্দ্রা ছুটে গেল । নন্দি করেছে কী!
ছয়টারও পরে নৌকা ভিড়ল বারেক টিলার ঘাটে। নেমে আসছে যাদুকাটা নদী। বড় মাছ কাটতে যেয়ে কোন এক মা আবছা আঁধারে কেটে ফেলেছিলেন তার শিশু সন্তানটিকে। সেই থেকে নদীর নাম যাদু কাটা। পাহাড়ের আড়ালে সন্ধ্যা ঘনায় তাড়াতাড়ি। সীমান্তের উপারের পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের মায়া। সেই মেঘে কে যেন ছুটে যায় আঁচল উড়িয়ে। আমার উদাস চোখ তাকিয়ে থাকে তার পানে অনিমিখ।

রাত
আকাশ গঙ্গার হাতছানি
রাত নামল বারেক টিলার ঘাটেই। রাতটা আশেপাশেই কাটানোর ইচ্ছা দল নেতার। নোঙর পড়ল আগের জায়গাতেই। আমরা নৌকার ভিতরে। গড়িয়ে নিচ্ছি গা। ডেরা থেকে বের হলেন নন্দি। হাতে ক্যামেরা আর ট্রাইপড। বলল, ‘মিল্কওয়ের ছবি তুলব’। আমার ট্রাইপডটা নতুন। এই ট্রিপেই প্রথম এনেছি লঙ এক্সপোজে ছবি তুলব বলে। আমিও পিছু নিলাম তার। নৌকার সামনে এসে দাঁড়ালাম দুজনে। আকাশ কালো ছাই। কোন তারা নেই। ‘লাভ নেই আকাশে মেঘ তারা ফুটবে না।’ নন্দি জোর দিয়ে বলল,‘অবশ্যই ফুটবে, বাজি ধরেন।’ ‘ধরলাম-দশটাকা বাজি।’ নন্দির যেন জানাই ছিল জিত হবে তার। সে নেমে গেল। আমিও নামলাম। কী আশ্চার্য! সত্যি দক্ষিণের আকাশটা তারায় তারায় ভরে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। পুব থেকে পশ্চিম বরাবর কালো আকাশটা হয়ে উঠল জীবনানন্দের খইক্ষেত। মিল্ক ওয়টাও এত স্পষ্ট! অনেক দিন চোখে পড়েনি। ‘দেখলেন আমি জিতে গেছি। টাকা দেন।’ আর আমিও হেরে গিয়ে বিরাট খুশি। দিয়ে দিলাম নন্দিকে দশটা টাকা। নন্দির বিজয়ের আনন্দ ভরা মুখটা তারাদের মতোই ঝলমলে। ট্রাইপডে ক্যামেরা বসিয়ে শুরু করল ছবি তোলা। নন্দির মনের আকাশটা অনেক বড় । তাই সে আকাশ গঙ্গাকে চায়। আমার শিল্পীমন ছোট। তার উপর মরুময়। অতবড় আকাশ গঙ্গাকে কোথায় দেব ঠাঁই। তাই আমি বেছে নিলাম বিষাক্ত হুলযুক্ত স্করপিয়ন এর নামে যার নাম- স্করপিয়াস বা বৃশ্চিক রাশি। প্রথম বার ঠিকমতো হল না। দ্বিতীয় বারে বেশ। আমাদের অবাক করে দিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই সব তারা কোথায় মুখ লুকাল। আর আমি বিশ্বাস করে বসলাম আমাকে হারানোর জন্য এ ছিল তারাদের ষড়যন্ত্র। কিন্তু এ যাত্রায় হেরে গিয়েও আমি খুশি।

ফিরতি যাত্রা
ঘুমন্ত নদীর বুকে আমাদের নৌকাটাও ঘুমিয়ে পড়ল। সকালটা কাটল এলোমেলো। কেউ পড়ে রইল ঘুমে। কেউ গেল শিমুল বনে দোসরাতরফ নোঙর তুলতে তুলতে বেলা বারটা। ফিরতি যাত্রায় পথ যেন সরে তাড়াতাড়ি। খাল বিল পেরিয়ে আবার এলাম টাঙ্গুয়া। গোলাবাড়িকে বায়ে রেখে ওয়াস টাওয়ারের পাশ দিয়ে আমরা টাঙ্গুয়া পার হলাম। নৌকা চলল একটানা। বাদশাগঞ্জের কলেজের সামনে যখন নৌকা ভিড়ল তখন মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল মাগরিবের আজান। আজ বৃষ্টি নাই। কিন্তু আকাশে মেঘ আছে। সেই মেঘই ডেকে আনল রাত আগেভাগে। অন্ধকারে ডুবন্ত পানির রাজ্যের দিকে আরেকবার তাকিয়ে আমরা অটোতে চেপে বসলাম। মোহনগঞ্জ থেকে রাত সাড়ে এগরটায় ট্রেন ছাড়বে।

Spread the love
%d bloggers like this: