রাজনৈতিক ক্ষমতাহীনতায় ভারতের সংখ্যালঘুরা

ভারতের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দেশটিতে সংখ্যালঘু মুসলিমরা কি ক্রমশ রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন হয়ে যাচ্ছেন? দেশটির সরকারের সাম্প্রতিক নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে কিন্তু তাই মনে হচ্ছে। দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় ধীরে ধীরে রাজনৈতিক শক্তিহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক প্রেমাংশু চৌধুরী। বুধবার পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারে লেখা এক নিবন্ধে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতে সংখ্যালঘুরা ক্রমশ রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন হয়ে যাচ্ছেন কিনা?

ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান তাবরিজের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবীতে বিক্ষোভের চিত্র।


প্রেমাংশু চৌধুরী তার লেখা নিবন্ধটিতে বলেছেন-অন্য বছর হলে বিরিয়ানি রান্না হত মহল্লার সকলের জন্য। শোভাযাত্রা বার হত। কাওয়ালির আসর বসত। হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর জন্মদিন বলে কথা। এ বছর মিলাদুন্নবী’তে অযোধ্যার মুসলিম মহল্লায় এসব কিছুই হয়নি। কোনও গন্ডগোলও হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরের দিনটা শান্তিতেই কেটেছে।

কাশ্মীরে ৫ আগস্ট ৩৭০ রদের ঠিক এক সপ্তাহ পরেই ছিল ইদ। কার্ফু শিথিল হয়। ইদগা খুলে দেওয়া হয়। নামাজের পর মিষ্টি বিলি করে পুলিশ। ইতস্তত বিক্ষোভ হলেও একটি বুলেটও খরচ করতে হয়নি। শান্তিতেই কেটেছিল কাশ্মীরের ইদ।অশান্তি নয়। আনন্দও নয়। দেশের নানা প্রান্তেই গল্পটা বিষাদের।

রামমন্দির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আদালতের রায় অবশ্যই শিরোধার্য। কিন্তু ভারতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং সামাজিক পরিবেশ দেখে মনে প্রশ্ন ওঠে, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতে একটা ‘পলিটিকাল ডিসএমপাওয়ারমেন্ট’ কি দেশের সংখ্যালঘু মানুষকে ক্রমশ কোণঠাসা করে ফেলছে? কাশ্মীর থেকে অযোধ্যা, তিন তালাক বিল থেকে এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিলের চাপে তাঁরা ক্রমশই নিজেদের খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলছেন? যাতে অশান্তি তৈরির অভিযোগের আঙুল তাঁদের দিকে না ওঠে। বিষণ্ণতার লক্ষণ যেন বড় স্পষ্ট। অনেকেই বলেছেন, কাশ্মীর-অযোধ্যার মানুষ এক সময় সবই মেনে নেবেন। পেটের তাগিদ, সময়ের প্রলেপ, সব ভুলিয়ে দেবে। সে কেমন মেনে নেওয়া? কেমন ভুলে যাওয়া? সংবিধান কি এই ভারতের কথা বলেছিল?

২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসে। লোকসভায় আসেন মাত্র ২৩ জন মুসলিম সাংসদ- একজনও বিজেপির নন। ১৯৫২’র পর মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব কখনও এত কম হয়নি। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে সংখ্যাটা হয়েছে ২৭। বিজেপি থেকে এ বারও মুসলিম সাংসদ নেই। জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ, বাংলা, বিহার, আসাম, কেরালা, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, লাক্ষাদ্বীপের মতো ১০টি রাজ্য-কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বাদ দিলে বাকি দেশের লোকসভায় কোনও মুসলিম জনপ্রতিনিধি নেই।

অযোধ্যা রায় ঘিরে আরএসএস নেতারা সহিষ্ণুতার বার্তা দিচ্ছেন। বার বার মুসলিম সমাজের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। মোহন ভাগবতের মতে, অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি হলে হিন্দু-মুসলমান সমাজের মধ্যে বৈর কাটবে। তবে, আরএসএস আসলে মনে করে, এ দেশের সকলেই হিন্দু। গত সেপ্টেম্বরেই সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত আরএসএস-এর সম্মেলনে বলেছিলেন, ভারতে বসবাসকারী সকলেরই জাতিগত পরিচয় হল সে হিন্দু। ভাগবতের যুক্তি ছিল, মুসলিমরা আরএসএস-এর শাখার পাশে থাকলেই সবচেয়ে নিরাপদে থাকেন। অপপ্রচারে কান না দিয়ে মুসলিমদের আরএসএস-এর শাখায় গিয়ে সব কিছু জেনে-বুঝে নিতেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। এ যেন দেশের মুসলিম সমাজকে তাঁদের ডানার নীচেই আশ্রয় নিতে আহ্বান— বশ্যতা স্বীকার করে নিলেই নিরাপদে থাকা যায়। এই সহিষ্ণুতার বার্তা, শান্তির আবহ, অযোধ্যার রায়ের পরে মারদাঙ্গা না হওয়ায় অনেকেরই মনে হচ্ছে, বেশ, এই তো নাগরিক সমাজ কেমন পরিণতমনস্ক, পরধর্মসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘুদের আর চিন্তা নেই।

সত্যিই কি তাই? ধরুন, অযোধ্যায় যদি উল্টো রায় হত? আদালত রামমন্দিরে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ায় আরএসএস অযোধ্যার রায়ে শুধু ‘উদ্দীপ্ত’ হয়েছে বলে জানিয়েছে। ‘বিজয়ী ভাব’ দেখায়নি। ‘সংযম’-এর নীতি নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সুপ্রিম কোর্টের রায়কে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নতুন মাইল ফলক হিসেবে তুলে ধরেছেন। নরেন্দ্র মোদি-মোহন ভাগবত বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এই রায় কারও হারজিত নয়। রায় উল্টো দিকে গেলেও তাঁরা একই কথা বলতেন কি?

নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ এক বছর আগেই ২০১৮-র অক্টোবরে মোহন ভাগবত নিজে দাবি করেছিলেন, রামমন্দির তৈরিতে আইন আনুক মোদি সরকার। আদালতের শুনানিতে দেরি হলে তাকে ‘ধৈর্যের পরীক্ষা’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। পরিষদও ফের আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। মোদি বুঝিয়েছিলেন, আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। লোকসভা ভোটের বৈতরনি পার হতেও মোদি দেশপ্রেম-জাতীয়তাবাদের আবেগে সওয়ার হয়েছিলেন। রামমন্দির তৈরির স্বপ্ন দেখিয়ে হিন্দুত্বের রাজনীতি করেননি। মোদির অবস্থান ছিল, আইনি ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেই রামমন্দির তৈরি হবে।

১৯৯২-এ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার আগে লালকৃষ্ণ আডবাণী রথযাত্রায় বেরিয়েছিলেন। সেই রথযাত্রা শুরু হয়েছিল গুজরাট থেকে। এবং তার একটি অংশের সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

Spread the love
%d bloggers like this: