জৈব অণুর স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন

বিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন এ উভয় ধারণা সম্পর্কে অনেক লোক_ এমন কি এখনো কুৎসা বা অপপ্রচারের শিকার। আমাদের পূর্বপুরুষরা পৃথিবীতে জীবনের সৌষ্ঠবের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিল, প্রাণ গঠনের কার্যক্রমের নৈপুণ্য দেখে অবাক হয়েছিল এবং একজন মহান কারিগর বা স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করেছিল। সূক্ষ্মতম একটি পকেট ঘড়ি থেকেও সবচেয়ে সরল এককোষী প্রাণী অনেক বেশি জটিল। কিন্তু তবুও ধরি গ্রান্ড ফাদার ক্লক হতে কতগুলো পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এ পকেট ঘড়ির উদ্ভব ঘটতে পারে না অথবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরাই একত্রিত হয়ে তৈরি হতে পারে না। একটি ঘড়ি ইঙ্গিত করে ঘড়ি প্রস্তুতকারকের। বিবর্তনের মূলমন্ত্রই হলো মৃত্যু ও সময়_ এটি হলো অসংখ্য প্রাণরূপের সেই মৃত্যু যারা পরিবেশের সঙ্গে অসম্পূর্ণরূপে অভিযোজিত হয়েছিল; আর এটি হলো সেই সময় যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিব্যক্তির (মিউটেশনে) দীর্ঘ পর্যায়ক্রমের জন্য ব্যয়িত হয়েছে যেগুলো ঘটনাক্রমে অভিযোজিত হয়েছিল, যা উপযুক্ত মিউটিশনের বিন্যাসগুলোর পুঞ্জীভবনের জন্যও ব্যয়িত হয়েছে। ইয়নের চেয়ে অনেক ছোট যে সহস্রাব্দ তাকে বোঝার ক্ষেত্রে আমরা যে দুর্বোধ্যতার সম্মুখীন হই তার ফলেই কিছু পরিমাণ ডারউইন ও ওয়ালেসের মতবাদের বিরোধিতা গড়ে ওঠে। যে জীবের আয়ুষ্কাল ৭ কোটি বছরের এক নিযুতাংশ মাত্র তার কাছে এ সুদীর্ঘ সময়টি কীভাবে প্রতিভাত হয়? আমরা হলাম প্রজাপতির মতো যেটি একটি দিনকে মহাকাল ভেবে বসে আছে।
এখানে এ পৃথিবীতে যা ঘটেছিল তা সম্ভবত অনেক গ্রহে প্রাণের বিবর্তনের সাধারণ ঘটনা হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি প্রোটিন রসায়ন অথবা নিউরোলজি অফ ব্রেইনের মতো অনুপুঙ্খ ব্যাপারগুলো বিবেচনা করি তাহলে পৃথিবীর এ গল্পগুলো সব মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অনন্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা জমাট বেঁধে ৪ শত ৬০ কোটি বছর আগে এ পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা ফসিল রেকর্ড হতে জানি প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছিল এর পরপরই, সম্ভবত প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে, আদিম পৃথিবীর জলাশয়ে অথবা মহাসাগরে। প্রথম জীবন এককোষী প্রাণের মতো এতটা জটিল অবস্থায় ছিল না। প্রথম স্পন্দন ছিল খুবই সরল ধরনের। ওই প্রাচীন দিনগুলোয়, সূর্য থেকে আগত অতিবেগুনি রশ্মি ও বিদ্যুৎ চমকানি সরল হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ অণুগুলো ভেঙে পৃথক করেছিল আদিম আবহম-লে, সেই টুকরো অংশগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংযুক্ত বা মিলিত হয়ে আরো অধিক জটিল অণু তৈরি করল। এ আদিম রাসায়নিক উপাদানগুলো মহাসাগরে দ্রবীভূত হয়েছিল, ক্রমে জটিলতার দিকে অগ্রসর হওয়া এক প্রকারের জৈব স্যুপ তৈরি হচ্ছিল, যে পর্যন্ত না একদিন আকস্মিকভাবে, একটি অণু জৈব স্যুপের অন্যান্য অণুকে বিল্ডিং বস্নক হিসেবে ব্যবহার করে নিজের প্রতিরূপ তৈরিতে সামর্থ্য হয়েছিল স্থূলভাবে।
এ জৈব অণুটি ছিল ডি-অক্সিরিবোনিউক্লিক এসিড বা ডিএনএ, এর সবচেয়ে প্রাচীন পূর্বপুরুষ পৃথিবীতে প্রাণ নিয়ন্ত্রণকারী অণুর মতো প্যাঁচানো একটি মইয়ের আকারের এ অণুটি, মইয়ের ধাঁপ বা সিঁড়িগুলো ৪টি বিভিন্ন আণবিক অংশের ভেতরেই পড়ে, যেগুলো গঠিত হয় জেনেটিক কোডের ৪টি অক্ষর দিয়ে। নিউক্লিটাইড বলে কথিত এ ধাঁপ বা সিঁড়িগুলো নির্দিষ্ট প্রাণ তৈরির জন্য বংশগতির নির্দেশাবলী লিপিবদ্ধ করে। পৃথিবীতে প্রত্যেক প্রাণ কাঠামোর আছে ভিন্ন ভিন্ন একগুচ্ছ নির্দেশাবলী, লেখা হয় মূলগতভাবে একই ভাষায়। প্রাণীগুলো যে ভিন্ন তার কারণটি হলো তাদের নিউক্লিক এসিডের নির্দেশাবলীর পার্থক্য। পরিব্যক্তি হলো নিউক্লিটাইডের পরিবর্তন, যা পরবর্তী প্রজন্মে বহমান, যা সত্যিকারভাবে বংশবিস্তারে অংশ নেয়। যেহেতু পরিব্যক্তি মাত্রই নিউক্লিটাইডের অনিয়ন্ত্রিত বা দৈবপরিবর্তন তাই পরিব্যপ্তির বেশির ভাগই ক্ষতিকর বা জীবাত্মক। কোনো প্রাণীর অধিকতর ভালো অবস্থার দিকে পরিবর্তন আনতে পরিব্যাপ্তির দীর্ঘকাল লেগে যায়। কিন্তু তারপরও এক সেন্টিমিটারের কোটি ভাগের একভাগ দৈর্ঘ্যের নিউক্লিটাইডের ছোট্ট অথচ ভালো একটা পরিবর্তন বিরল এক ঘটনা, তবে এভাবে বিবর্তন এগিয়ে চলেছে।

Spread the love
%d bloggers like this: