শীতে বাড়ে অ্যাজমার প্রকোপ

খুবই পরিচিত অসুখ অ্যাজমা। যেকোনো বয়সে যে কেউ অ্যাজমায় আক্রান্ত হতে পারেন। এটি ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি অসুখগুলোর একটি। এটা সারা জীবনের রোগ হলেও সঠিক চিকিৎসা নিয়ে ভালো থাকা যায়। লিখেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা খানম

বিগত কয়েক দশকে বিশ্বজুড়ে অ্যাজমার ব্যাপকতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বজুড়ে ২৩৫ মিলিয়ন মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত।

অ্যাজমা কী?

অ্যাজমা হলো এক ধরনের প্রদাহ, যা শ্বাসনালিকে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের প্রতি অতিসংবেদনশীল করে তোলে। শ্বাসনালির এই অতিসংবেদনশীলতাই অ্যাজমার কারণ, যাতে মূলত শ্বাসকষ্ট হয়। কারো আগে থেকে অ্যাজমা না থাকলেও শীতে প্রথমবারের মতো যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন।

কারণ

অ্যাজমার প্রকৃত কারণ আজও অজানা। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জন্মগত ও পরিবেশগত দুটি উপাদানই এর জন্য দায়ী। কোনো একজনের অ্যালার্জিজনিত সমস্যা থাকলে তার অ্যাজমা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সাধারণত অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীর পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই ধরনের উপসর্গ থাকে। তবে অ্যাজমা অ্যালার্জিজনিত ও অ্যালার্জিবহির্ভূত দুই ধরনেরই হতে পারে। বেশির ভাগ রোগীর অ্যাজমা অ্যালার্জিজনিত। চারপাশের বিভিন্ন অ্যালার্জিক উপাদান এতে প্রভাব ফেলে। যেমন—আরশোলা, হাউসডাস্ট মাইট (এক ধরনের কীট), গৃহপালিত পশুর লোম ও খুশকি, ফুলের পরাগ, ছত্রাক, ধুলাবালি, ধোঁয়া (সিগারেট, লাকড়ির চুলা, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া)। কিছু খাবার এবং এসবে ব্যবহৃত উপাদানগুলো, কিছু কিছু ওষুধ যেমন—এসপিরিন, ব্যথানাশক ওষুধ (NSAID) ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত বিটাবকার ওষুধ ব্যবহারে অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীদের অ্যাজমার উপসর্গ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচণ্ড মানসিক চাপেও অ্যাজমার উপসর্গ বাড়তে পারে। প্রতিরোধক্ষমতা পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই শিশু বয়সে বারবার শ্বাসনালির সংক্রমণে পরবর্তী সময় অ্যাজমার ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় মায়ের খাদ্যাভ্যাস ও ধূমপান শিশুর অ্যাজমা হওয়ার জন্য দায়ী।

উপসর্গ

অ্যাজমার সাধারণ উপসর্গগুলো হচ্ছে শ্বাসকষ্ট, কাশি, শ্বাসের সঙ্গে বুকে এক ধরনের শব্দ তৈরি হওয়া, বুকে চাপ বোধ করা—যেগুলো সাধারণত শেষরাতে বা ভোরের দিকে বাড়ে। তবে সব রোগীর উপসর্গ এক রকমের হয় না। অনেকে শুধু দীর্ঘমেয়াদি শুকনো কাশিতে ভুগতে পারেন। একে কফ ভ্যারিয়েন্ট অ্যাজমা বলা হয়ে থাকে। আমেরিকান অ্যাজমা ও অ্যালার্জি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ৯৩ শতাংশ রোগীর অ্যাজমার উপসর্গ, বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট ব্যায়াম করার সময় বেড়ে যেতে পারে। অনেক সময় সাধারণ মানুষেরও এমন হতে পারে। একে এখনকার দিনে ব্যায়ামজনিত শ্বাসনালির সংকোচন বলা হয়। আগেকার দিনে একে ব্যায়ামজনিত অ্যাজমা বলা হতো।

সতর্কতা

অ্যাজমার উপসর্গ হঠাৎ বেড়ে গেলে এবং রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার অধীনে না নিলে তা রোগীর জন্য প্রাণঘাতীও হতে পারে। সংকটাপন্ন অবস্থার উপসর্গগুলো হচ্ছে—প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, বুকের পিঞ্জর শ্বাসের সঙ্গে ভেতরে ঢুকে যাওয়া, বাইরে থেকে বুকে এক ধরনের শব্দ শুনতে পাওয়া, অক্সিজেনের অভাবে রোগীর নীল হয়ে যাওয়া (বিশেষ করে ঠোঁট, নখ, হাতের তালু), ঘাম হওয়া। এমতাবস্থায় রোগী মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে যেতে পারেন। এমন হলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন, নেবুলাইজারসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা দিতে হবে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও রোগীকে নিয়মিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা উচিত।

পরীক্ষা

চিকিৎসক রোগীর বিস্তারিত অসুখের বিবরণ, পারিবারিক ইতিহাস ও রোগীর শারীরিক পরীক্ষা করেই অ্যাজমা আছে কি না তা বলে দিতে পারেন। শ্বাসনালির সংকোচন-প্রসারণ দেখার জন্য আদর্শ পরীক্ষা হলো স্পাইরোমেট্রি। রোগী নিজেও পিক ফ্লো মিটার ব্যবহার করে বাড়িতেই নিজের অসুখের অবস্থার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

প্রতিরোধে করণীয়

♦ নিয়মিত ওষুধ সেবন করা।

♦ যেসব খাবার বা উপাদান অ্যালার্জি বাড়ায়, সেগুলো পরিহার করা।

♦ ধূমপান পরিহার করা।

♦ খুব ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় না যাওয়া, ব্যায়াম না করা।

♦ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা।

♦ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, কেননা স্থূলতা অ্যাজমার উপসর্গ বাড়ায়।

♦ উপসর্গ পর্যবেক্ষণ ও নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।

অ্যাজমা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ নয়, তবে নিয়মিত ওষুধ সেবনে উপসর্গবিহীন থাকা সম্ভব। কিছু ওষুধ তাত্ক্ষণিক উপসর্গ নিরাময় করে এবং কিছু ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি কাজ করে উপসর্গের বেড়ে যাওয়া প্রতিহত করে। অ্যাজমার ওষুধগুলো ইনহেলারের সাহায্যে ব্যবহার করা উচিত। এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়। ইনহেলার ব্যবহার করলে পুরো ওষুধটাই ফুসফুসে গিয়ে কাজ করতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত উপসর্গে নেবুলাইজারের মাধ্যমে ওষুধ নেওয়া যেতে পারে।

Spread the love
%d bloggers like this: