ফিরিয়ে আনা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের
দুরন্ত ডেস্ক:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া অনেকটা আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে দেশটির আগ্রহের কথা জানা গেছে।
নিশ্চিত তথ্য পাওয়ার পর শরিফুল হক ডালিমকে স্পেন আর মোসলেম উদ্দিনকে জার্মানি থেকে ফেরত আনার ব্যাপারে দুই দেশের সঙ্গে সরকার যোগাযোগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম হত্যার রায় কার্যকরের ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় খুনির অন্যতম নূর চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থানের কারণে ফেরত দেবে না বলে জানিয়ে যাচ্ছে কানাডা। পলাতক অন্য দুই খুনি খন্দকার আবদুর রশীদ ও আবদুল মাজেদ কোথায় আছেন, সেটা বাংলাদেশ যে নিশ্চিতভাবে জানে না তা স্বীকার করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
গত সপ্তাহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি আছে। ‘যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ না। আর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে বলে তাঁকে তাঁর দেশে ফেরত পাঠানো হবে না, এমন কোনো অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটন সফরের সময় অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর তিন মাস পর, অর্থাৎ ২৭ মে মার্কিন আইনি পরামর্শক সংস্থা স্কাডেন এলএলপিকে রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত আনার কাজে যুক্ত করা হয়। সংস্থাটির পক্ষে মামলার তদারক করছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাবেক আইনি পরামর্শক গ্রেগরি ক্রেইগ। ইতিমধ্যে গ্রেগরি ক্রেইগ ও স্কাডেন এলএলপিতে তাঁর সহকর্মীরা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, আইন দপ্তর, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও অভিবাসন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা আলোচনা করেছেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে তাঁরা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জন স্টুয়ার্ট ব্রুসের সঙ্গে।
রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে গত বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী মার্কিন আইন দপ্তরে অনুরোধ জানান। মার্কিন আইন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে স্কাডেন এলএলপি ঢাকায় জানিয়েছে, রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। গত জুনে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপসহকারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক লিসা কার্টিসের সঙ্গে বৈঠকে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিতে পুনরায় অনুরোধ জানান।
প্রসঙ্গত, বেশ কয়েক দফা রাজনৈতিক আশ্রয় লাভে ব্যর্থ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের অন্যতম এ কে এম মহিউদ্দিনকে ২০০৭ সালের জুনে বাংলাদেশের অনুরোধে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি শরিফুল হক ডালিম কখনো পাকিস্তানে, কখনো কেনিয়ায়, কখনো লিবিয়ায় আবার কখনো ইউরোপে—এমন নানা তথ্য সরকার পেলেও তা অসমর্থিত ছিল। সর্বশেষ স্পেনে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে সরকার নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনৈক মিজানুর রহমানের সহায়তায় এখন স্পেনেই আছেন শরিফুল হক ডালিম। এরপর তাঁকে ফিরিয়ে আনতে স্পেনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে বাংলাদেশ।
কানাডার মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই সদস্যরাষ্ট্র জার্মানি ও স্পেনে মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হয়েছে।
ফিরে দেখা
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে পদে পদে বাধা আসে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তত্কালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। কিন্তু এরপর ছয় বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচার-প্রক্রিয়া।
দীর্ঘ ছয় বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আপিলের অনুমতির প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এর মধ্য দিয়ে ১৩ বছর ধরে চলা এ মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শেষ হলে দায়মুক্ত হয় বাংলাদেশ। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ও মুহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর হয়। ওই রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আসামি আজিজ পাশা। পলাতক বাকি ছয়জন হলেন খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও মোসলেম উদ্দিন। আসামিরা সবাই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
খুনিদের চাকরি হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালের ৮ জুন প্রকাশিত এক সরকারি প্রজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সবাইকে বিভিন্ন দূতাবাসে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশীদ ছাড়া বাকিরা চাকরির প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
নূর চৌধুরী ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে তিনি ইরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। পরে আলজেরিয়া ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং হংকংয়ের কনসুলেটে বদলি হন তিনি। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি হংকংয়ে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ছিলেন। ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। ওই বছরই তিনি কানাডায় গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কানাডার রাজধানী টরন্টোর ১৩ কিলোমিটার দূরে ইটোবিকোকে তিনি এখন অবস্থান করছেন।
রাশেদ চৌধুরী ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনসুলেটে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি কেনিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করেন। ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে তাঁকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে ওই বছরের জুলাইয়ে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো চলে যান।
১৯৭৬ সালে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসেবে নিয়োগ পান শরিফুল হক। ১৯৮২ সালে হংকংয়ের কনসুলেটে বদলি হয়ে সেখানে তিনি ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। হংকং থেকে ওই বছরই তাঁকে কেনিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বদলি করা হয় এবং ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে দায়িত্ব পালন করেন।