পাঠ্যবইয়ে কী শিখছে শিশুরা : দুইজনের সম্মতিতে যৌন অনুভূতি প্রকাশ দোষের নয়!

মেহেদী হাসান : রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণকৃত ‘নিজেকে জানো’ বইয়ে লেখা হয়েছে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব দোষের কিছু নয়। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে ভালো লাগার পরের পর্যায়ে যৌন অনুভূতি এমনকি যৌন আকর্ষণও সৃষ্টি হতে পারে। এ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে, যেমন- চিঠি লিখে, দেখা করে, হাত ধরে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরেকটু কাছাকাছি এসে। যৌন অনুভূতি প্রকাশ করা দোষের কিছু নয়, তবে সেটি হতে হবে দুইজনের সম্মতিতে, মার্জিত ও শালীনভাবে।
নিজেকে জানো বইটিতে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ, প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা, পরস্পরকে ভালো লাগা বা প্রেমের অনুভূতি প্রকাশের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে প্রথমে। এরপর ভালো লাগা পরের পর্যায় থেকে পরস্পরের প্রতি যে যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি হয় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটির শুরুর দিকে একটি অধ্যায়ের নাম ‘বাইরের পরিবেশ’। এ অধ্যায়ের একটি শিরোনাম ‘একটি ছেলে আমার সাথে প্রায়ই গল্প করতে চায়। আমার যেন কেমন ভয় লাগে। কেন এমন হয়?’ এখানে লেখা হয়েছে এ বয়সে ছেলেরা মেয়েদের সাথে গল্প করতে চাইতেই পারে। একই ভাবে মেয়েরাও ছেলেদের সাথে কথা বলতে চাইতে পারে। কথা বলা বা গল্প করার মধ্যে কোনো দোষ নেই। এতে কারো ভালো লাগে বা আবার কারো ভয়ও লাগতে পারে। তবে সাধারণত এতে ভয়ের কিছু নেই। যখন ছেলেমেয়েদের এমন সম্পর্ক বেশি দূর গড়ায়, আর অবাধ মেলামেশার দিকে এগোতে থাকে তখন সময়মতো নিজেকে সরিয়ে নেয়াটাই ভালো।
বইটির আরেকটি অধ্যায়ের নাম ‘আকর্ষণ’। এ অধ্যায়ের একটি শিরোনাম ‘একটা ছেলেকে নিয়ে আমি অনেক ভাবি। মাঝে মধ্যে স্বপ্নেও দেখি। আগে তো এমন হতো না। এখন কেন হয়?’ এখানে লেখা হয়েছে কাউকে নিয়ে এ রকম ভাবনা হওয়া ভালো লাগার লক্ষণ। এটি আবেগের বহিঃপ্রকাশ, যা সাধারণত এ বয়সে হতে পারে। পরের পর্যায়ে এটি ভালোবাসায়ও রূপ নিতে পারে। কোনো ছেলেকে গভীরভাবে ভালোবাসার আগে তার সম্পর্কে আগেই সব কিছু জেনে নেয়া উচিত।
এ অধ্যায়ের আরেকটি শিরোনাম ‘বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়ে পরস্পরকে এত পছন্দ করে কেন’? এখানে লেখা হয়েছে বয়ঃসন্ধিকালে শরীরের সব পরিবর্তনের মূলে রয়েছে এক ধরনের রসায়ন বা হরমোন। এ হরমোনের প্রভাবেই ছেলে ও মেয়ে পরস্পরকে জানতে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। যেহেতু এটি একটি নতুন অনুভূতি এই পর্যায়ে তোমাদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্টও হতে পারো। বন্ধুদের মধ্যে কোনো একজনকে খুব ভালো লাগতে পারে এবং তার কাছাকাছি হতে ইচ্ছে করতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে কিছু সময় নিয়ে নিজের এই অনুভূতিকে বুঝে নেয়াটাই ভালো।
এ অধ্যায়ে আরো লেখা হয়েছে ছেলে ও মেয়েরা এ বয়স থেকে একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এ ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। ছেলেরা চায় মেয়েদের আকর্ষণ করতে আর মেয়েরা চায় ছেলেদের। এ বয়সে ছেলেমেয়েদের নিজেকে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
আকর্ষণের পরের অধ্যায়ের নাম ‘বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা’। এ অধ্যায়ে একটি শিরোনাম হলো ‘ছেলেদের সাথে ছেলেদের বন্ধুত্ব হয়। ছেলের সাথে একটি মেয়ের বন্ধুত্ব হলে এটা কি খারাপ?’ এখানে লেখা হয়েছে ছেলেমেয়ে বন্ধুত্বে কোনো ক্ষতি নেই। কিশোর-কিশোরী বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে জানা পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতেই পারে । তবে আমাদের সামজে ছেলে ছেলে অথবা মেয়ে মেয়ের বন্ধুত্ব যতটা সহজে গ্রহণ করে ঠিক একইভাবে ছেলের সাথে মেয়ের বন্ধুত্বের ব্যাপারটা অনেকে সহজে মেনে নেয় না। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব দোষের কিছু নয়। তবে ছেলে ও মেয়ের বন্ধুত্ব শুধু বন্ধুত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। কোনোভাবেই এটি যেন শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত না গড়ায়।
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার পরের অধ্যায়ের নাম ‘অনুভূতি প্রকাশ’। এ অধ্যায়ের একটি শিরোনাম ‘ভালো লাগার পরের পর্যায়’। এখানে লেখা হয়েছে ভালো লাগার পরের পর্যায়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌন অনুভূতি এমনকি যৌন আকর্ষণও সৃষ্টি হতে পারে। এ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে, যেমন-চিঠি লিখে, দেখা করে, হাত ধরে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরেকটু কাছাকাছি এসে। যৌন অনুভূতি প্রকাশ করা দোষের কিছু নয়, তবে সেটি হতে হবে দুইজনের সম্মতিতে, মার্জিত ও শালীনভাবে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে যৌন অনুভূতিকে যতটুকু সম্ভব সংযত করে রাখার চেষ্টা করাটাই ভালো। আরেকটা ব্যাপার মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রেমিক ও প্রেমিকার কথাবার্তা ও সম্পর্ক যেন নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, সেটি যেন সবার আলোচনার বিষয় না হয়।
এ অধ্যায়ে আরেকটি শিরোনাম হলো ‘আমি কি করে বুঝবো যখন একটি মেয়েকে আমার ভালো লাগে’? এখানে লেখা হয়েছে তোমার সাথে অনেক মেয়েরই পরিচয় হতে পারে আলাপও হতে পারে। তবে সবাইকে যে ভালো লাগবে তেমন কোনো কথা নেই। যে মেয়ের কথা তোমার প্রায়ই মনে পড়বে, যার হাসি- যার কথা তোমার শুনতে ইচ্ছা করবে, যার সাথে একটু কথা বলার জন্য বা দেখা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবে মনে করবে সেই মেয়েটিকেই তোমার ভালো লাগে। এই ভালো লাগাটা তাকে তুমি কোনো কিছু উপহার দিয়ে মুখে বলে বা চিঠি লিখেও জানাতে পারো। তবে মেয়েটিও তোমাকে পছন্দ করছে কি-না তা জানাটা খুব জরুরি। কারণ তুমি পছন্দ করছ বলেই মেয়েটিও তোমাকে পছন্দ করছে এমনটি নাও ঘটতে পারে। এ অবস্থায় তোমার পছন্দ জোর করে মেয়েটির ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়। মনে রাখার ব্যাপার হচ্ছে, সবারই নিজস্ব মতামত আছে এবং দুইজনের দুইজনকে যদি ভালো না লাগে তবে সম্পর্ক গভীর বা স্থায়ী হয় না।
বইয়ের এই সব অধ্যায়ের কথা উল্লেখ করে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা বলেছেন কিশোর-কিশোরীদের প্রেম শিখানো ছাড়া এর উদ্দেশ্য আর কিছু নয়। এমনিতেই সিনেমা টেলিভিশন ও ইন্টারনেট যৌন বিষয়ে অবাধ প্রচার-প্রচারণা চলছে। কিন্তু তা ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় বলেই বিবেচিত হয় কিশোর তরুণদের কাছে। কিন্তু স্কুলের পাঠ্য বইয়ে যদি তা স্থান পায় তবে কিশোরদের তরুণদের কাছে বিষয়টি আর নিষিদ্ধ থাকে না। আলোচ্য বইটির ক্ষতিকর প্রভাব ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়েছে বলে অনেক শিক্ষক-অভিভাবক উল্লেখ করেছেন। তারা বইটিকে প্রেম যৌনতার ‘হাতে কলমে’ শিক্ষা বলে বর্ণনা করে অবিলম্বে বইটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
উৎসঃ nayadiganta

 

Spread the love
%d bloggers like this: