রাজধানী সোনারগাঁ

মাসুম সায়ীদ

“একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়/ যেথায় কোকিল ডাকে কুহু/ দোয়েল ডাকে মহু মুহু/ নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়। পিদিম জ্বালা সাঁজের বেলা/ শান বাঁধানো ঘাটে/ গল্পকথার পানসি ভিড়ে রূপ কাহিনীর বাটে।”-গাজী মাজহারুল আনোয়ার

ফাল্গুনের প্রথম দিন। ঘুম ভাঙ্গল পাখির গানেই। নামাজের পর তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে পড়লাম নাস্তা না করেই।  যানজটে স্থবির হওয়ার আগেই পেরিয়ে যেতে চাই সাধের রাজধানী ঢাকা। আজ প্রাণে ডাক পড়েছে সোনারগাঁয়ের – বাংলার প্রাচীনতম রাজধানী। রূপকথার মতোই স্বপ্নময়ী আজও। ঠিক গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গানের মতোন।
শিল্পাচার্য জয়নুলের উদ্যোগে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে লোক ও কারু শিল্প জাদুঘর। এই জাদুঘর প্রঙ্গণে প্রতিবছর মেলা বসে এক মাসের জন্য। জানুয়ারির ১৪ তারিখে শুরু আর ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে শেষ। মেলার অন্যতম আকর্ষণ হারিয়ে যেতে বসা বায়েস্কোপ। আমার এবারকার সফরের উদ্দেশ্য এই বায়োস্কোপ। সাভার থেকে গুলিস্তান আসতেই বেজে গেল নয়টা। সোনারগাঁয়ে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো বাস সার্ভিস হলো দোয়েল পরিবহণ। মনের মধ্যে একটা তাড়াহুড়া ভাব ছিল। মেলা শেষের দিকে তাই ভিড় হবে। লোকের ভিড় হওয়ার আগেই বায়োস্কোপ ওয়ালাকে ধরতে হবে। নইলে শান্তিমতো দুটো কথা বলার মওকা পাওয়া যাবে না। গুলিস্তান থেকে সোনারগাঁয়ের মোগড়া পাড়া বাসস্টান্ড পর্যন্ত ভাড়া জনপ্রতি তেতাল্লিশ টাকা। পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়ে দুটো টিকিট নিয়ে বাকি টাকা বুঝে না নিয়েই ছুটছিলাম বাসের দিকে। টিকেট মাস্টার ডেকে বাকি টাকা ফেরত দিলেন। তাঁর সততায় মুগ্ধ হলাম। ধন্যবাদ দিয়ে উঠে পড়লাম বাসে। একটু পরেই ছেড়ে দিল বাস। যাত্রাবাড়ির ফ্লাইওভার হওয়ায় নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেলাম বাকি শহরটুকু। তাড়াহুড়ার ভাব কাটিয়ে মন শান্ত হল। শান্ত মন ছুটে গেল প্রাচীন কালের রাজধানী সোনারগাঁয়।      
ঢাকার অনেক আগেই রাজধানী হতে পেরেছিল মেঘনা-শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র-ধলেশ্বরী দ্বারা বেষ্টিত দ্বীপতুল্য ছোট্ট জনপদ এই সোনারগাঁ। এর মাটির রং সোনার মতোই উজ্জ্বল বা আশেপাশেই ছিল এক সোনার খনি কিংবা এর নদীগুলোর পানিতে ভেসে আসত সোনার রেনু অথবা এই মাটিতে লালিত সন্তানেরা শিক্ষাদীক্ষায় হয়ে উঠত সোনার মানুষ – এর যে কোন কারণেই হোক , সোনা, স্বর্ণ বা সুবর্ণ – মূল্যবান এই ধাতুটার নামেই যে এ জনপদের নাম তাতে সন্দেহ নেই। সেই প্রাচীন কাল থেকেই এটা ছিল সমৃদ্ধ এক জনপদ। রাজধানী বা রাজার নিবাস হওয়ার পিছনেও এই একই কারণ। সাথে চতুর্দিকে নদীর  প্রকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনি। রাজা দুনজ মাধব বা রায় একে রাজধানীতে পরিণত করে ছিলেন প্রথম। ১২৮৩ সালে। তারও আগে সোনারগাঁকে আলোকিত ও পরিচিত করে তুলেছিলেন মুসলিম দরবেশ শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওমা। বোখারায় তাঁর জন্ম। শিক্ষা লাভ করেন খোরাশানে । ধর্মতত্ত, ফিকাহ ও হাদীস শাস্ত্রে অসামান্য পান্ডিত্য ছিল তাঁর। এমনকি পারদর্শী ছিলেন রসায়ন, প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং যাদুবিদ্যায়ও। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের রাজত্বের শুরুর দিকে তিনি দিল্লিতে আসেন। তখন সোনারগাঁ ছিল দিল্লির অধিন। সুলতানের পরামর্শে শরফুদ্দিন সোনারগাঁয়ে আসেন ১২৭৪ থেকে ১২৭৭ সালের কোন এক সময়ে। সোনারগাঁয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্ববিদ্যালয়। যা খানকাহ হিসেবে পরিচিত ছিল তখনকার দিনে । এই খানকাতেই তৈরি হত সোনার মানুষ। বিহারের বিখ্যাত মনীষী  মখদুম-উল-মুলক শেখ শরফউদ্দীন এহিয়া মানেরী। এখানেই পড়তেন। গুরু শিষ্যের প্রায় এক নাম। শেখ আলাউদ্দিন আলাউল হক, শেখ বদর-ই-ইসলাম, শেখ জাহিদ, সাইয়িদ ইবরাহিম দানিশমন্দ, আর অনেক জ্ঞানীগুণী পন্ডিত জন্ম নিয়েছিলেন এখানে । রচিত হয়েছে অনেক গ্রন্থ’। কোরআনের তাফসির। ইসলামী বিধি-বিধান। এমন কী  একটি সংস্কৃত-বাংলা অভিধানও রচিত হয়েছিল এখানে মুসা খানের রাজদরবারের সভাকবি নাথরেশ কর্তৃক।
পূর্ব বাংলার এক আঞ্চলিক নৃপতি রাজা দুনজ বিক্রমপুর থেকে তার রাজধানী ¯ স্থানান্তর করেন সুবর্ণগ্রামে। শুরু হয় রাজধানী সোনারগাঁয়ের যাত্রা। চৌদ্দশতকের শুরুর দিকে সোনারগাঁয়ের গুরত্ব খানিকটা ম্লান হয়ে পড়লেও ১৩৩৮ সালে ফখরউদ্দীন মোবারক শাহ বাংলায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করে সোনারগাঁকে করেন রাজধানী।  শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দর শাহ রাজধানী নিয়ে যান লখনৌতে। সোনারগাঁ পরিণত হয় প্রাদেশিক রাজধানীতে । সিকান্দর মাহের পুত্র গিয়সউদ্দীন আযম শাহ পিতার সাথে বিদ্রোহ করে চলে আসেন সোনারগাঁ। এখানে এসে যুদ্ধে পিতাকে হারিয়ে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। সোনারগাঁ হয় তাঁর রাজধানী। তারপর ঈশ খাঁ, মুসা খাঁ পর্যন্ত সোনারগাঁ-ই ছিল বাংলার রাজধানী। ১৬১১ সালে মধ্য এপ্রিলে মুগল সুবেদার ইসলাম খান সোনারগাঁ দখল করেন।  অবসান হয় বাংলার স্বাধীন শাসকদের রাজত্ব। ইসলাম খান জাহাঙ্গীর নগর নাম দিয়ে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন মুগলদের রাজধানী। সেই থেকে বিবর্ণ হতে থাকে সুবর্ণগ্রামের বিভা।
প্রাচীনকাল থেকেই সোনারগাঁ ছিল আন্তর্জাতিক নৌবন্দর। চৌদ্দ শতকের গোড়ার দিকে এটি পরিণত হয় বাণিজ্য কেন্দ্রে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জাহাজ এসে ভিড়ত এখনে। ১৩৪৬ সালে ইবনে বতুতা সোনারগাঁ এসে দখেছিলেন চীনের একটি জাহাজকে জাভার (ইন্দোনেশিয়া) উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে। চীনা পিরব্রাজক মা হুয়ান এসেছিলেন ১৪০৬ সালে। তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে  সোনারগাঁয়ের সমৃদ্ধি আর ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা । একই কথা বলেছেন ব্রিটিশ পরিব্রাজক রালফ ফিচ ১৫৮৬ তে। রেশম শিল্প চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল সোনারগাঁয়ের কারিগরদের হাতেই। এখানকার মসলিন আলোড়ন তুলেছিল মোগল হেরেম থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে। যার প্রভাব ছিল পরবর্তী কয়েকশ বছর।  এমন কি আজকের দিনেও। ঢাকার জামদানী  মসলিনেরই উত্তরসূরী। এই মসলিনের সূত্র ধরে গড়ে উঠেছিল ব্যবসায়ী নগরী পানাম। যার বাড়িগুলো আজও সাক্ষ্য বহন করছে স্থাপত্য কলায় ও নগর পরিকল্পনায় আধুনিকতার পরিচয়ের।
আমার কল্প ভ্রমণে ছেদ পড়ল বাসের হেলপারের ডাকে। ‘ সোনারগাঁ, সোনারগাঁ- নামেন।’ আড়মোড়া ভেঙ্গে নেমে পড়লাম বাস থেকে। তারপর অটোরিক্সায় জাদুঘরের পথে। তারও আগে ‘ইত্যাদি’ হোটেলে সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম রুটি আর সবজিতে। ছিমছাম আর মনোরম হোটেল। বড় রাস্তর ধারেই।
মেলা প্রাঙ্গণে তখনও শীতের সকালের আমেজ। দোকানীরা কেবল পশরা সাজাচ্ছে। মূল মেলা প্রাঙ্গণে একটা গাছের ছায়ায় গামছায় ঢাকা বায়োস্কোপটা পাওয়া গেল। কিন্তু লোকটা নাই। ডিজিটাল যুগ। বাক্সের গায়ে সেলফোনের নাম্বারটা ছিল ঠিকানা সমেত। রিং করতেই পাওয়া গেল তাকে। এইতো এলেন বলে। এলেন শিঘ্রই। কথা হল। বায়োস্কেপও দেখা হল। আমাদের দিয়েই দিনটা শুরু। তাই টাকা দিলাম। নিতেই হল প্রথম কাস্টমার বলে। তারপর চা খাওয়ালেন। দর্শকের ভিড় বাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই ফাঁকে ঢু দিলাম পানাম নগরে। পুরাকীর্তি দেখলে বরাবর যা হয় আমার তাই হল – চলে গেলাম ঘোরের মধ্যে।  এতটা যে, কানে আসে পায়ের আওয়াজ, গুঙ্গুরের রুমঝুম। আস্তাবলে সহিসের হাঁকডাক- সব। ছাপিয়ে উঠে দর্শকদের কথাবার্তা আর শিক্ষা সফরে আসা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাকলিকেও। অনেক ছবি ক্যামারায় তার চেয়ে বেশি মনে। দিন গড়াল মধ্য দুপরে। নিস্তব্ধ শূন্য বাড়িগুলো যেন আরও বেশি করে কলরব করে উঠল। কান পেতে নয় মন পেতে শুনতে হয় সে কথা। বেরিয়ে এলাম পানাম থেকে।
আর একবার মেলায়। এখন বেশ জমজমাট। বায়োস্কোপ দেখার জন্যও বেশ ভিড়। কয়েকটা ছবি নিয়ে নামলাম পথে। ইত্যাদিতেই আবার। দুপুরের খাবার খেতে খেতে বেজে গেল সাড়ে তিনটা। তারও ঘণ্টা খানেক পর গিয়ে দাঁড়ালাম শাহ চিলাপুর। গিয়াশ উদ্দিন আজম শাহের পাশে। নিরেট কষ্টি পাথরে বাঁধানো কবর।  লোকেরা বলে ‘কালা দরগা’। বিদ্রোহী যুবরাজ! কী আর করার ছিল তার? বিমাতার বৈরীতা। তা না হলে হয়ত প্রাণটাই যেত? সত্যিটা সবজান্তাই জানেন। আর খানিকটা এগিয়ে গেলেই পাঁচপিরের মাজার। সেখান থেকে ফেরার পথে ইবরাহিম দানিশমন্দের মাজার। এতেই ফুরিয়ে গেল দিন। ফিরতে হবে। সোনারগাঁয়ে সোনার মানুষ তৈরির কারিগর শরফুদ্দিনের দরগাটি খুঁজে বের করার সময় হল না। আর একদিন আসব। দোয়েলের কাউন্টারে একটা বাস দাঁড়িয়ে ছিল। উঠে পড়লাম। সিটটাতে গা ঢেলে দিতেই মনে পড়ল সারা দিন তেমন একটা বসাই হয় নাই। #
যেভাবে যাবেনঃ গুলিস্তানে স্টেডিয়ামের গেট থেকে সোনারগাঁয়ের বাস ছেড়ে যায়। দোয়েল পরিবহণের সার্ভিসটাই ভালো। ভাড়া জনপ্রতি তেতাল্লিশ টাকা। মোগড়া পাড়া বাসস্টেন্ড থেকে পূর্ব দিকে জাদুঘরও পানাম নগর পূর্ব দিকে আর পশ্চিমে গিয়াশ উদ্দীন আজম শাহ-এর মাজার। রিক্সা ভাড়া ২৫ থেকে ৩০/=। জাদুঘরে প্রবেশ ফি ২০ টাকা। বুধ ও বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বন্ধ।

Spread the love
%d bloggers like this: