সাবধান! ঘরে-বাইরে শিশুর উপর যৌন নির্যাতন

index
কেইস ১
নির্ভানা। আট বছরের এক বালিকা। দেহে মেয়েসুলভ কোনো বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠে নি। তাতে কি? ওর বড় পরিচয় ও একটা মেয়ে। মেঝো চাচা তাই সময় পেলেই কোলে তুলে নেন নির্ভানাকে। নির্ভানার ছোটো ভাইটির চেয়েও চাচা ওকেই কোলে নিয়ে আদর করতে ভালোবাসেন বেশী।
নির্ভানা একটুও থাকতে চায় না চাচার কোলে। ছটফট করতে থাকে। বাধ্য হয়ে চাচা নামিয়ে দেন ভাস্তিকে। কিন্তু তার আগেই স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেন ইচ্ছামতো। সবার চোখের আড়ালে, বিশাল এক থাবা নেমে আসে নির্ভানার বুকে।
প্রতিবারই।

কেইস ২
ভার্সিটি পড়ুয়া মামাতো ভাই রিপন বেড়াতে এসেছে অসিনদের বাসায়। অসিন, নয় বছরের বালিকা, পড়ে ক্লাস থ্রিতে।
ভাইয়াটা খুব মজার। গল্প বলে মাতিয়ে রাখে অসিন আর তার এক বছরের বড় ভাই অমিতকে।
এর মধ্যে অসিনের বাবা-মা একদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গেলেন। গার্ডিয়ান হিসেবে রেখে গেলেন রিপনকে। রিপন খুব দায়িত্ববানের মতো দুই ভাইবোনকে স্নান করিয়ে, ভাত খাইয়ে দিলো। তারপর ওদের সাথে লুকোচুরি খেলতে আরম্ভ করলো। অমিত খুঁজে বের করবে বাকী দুইজনকে।
রিপন লুকানোর নাম করে অসিনকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
হতভম্ব অমিত ডাকাডাকি শুরু করলো, “দরজা খুলো। দরজা বন্ধ রাখলে খুঁজবো কীভাবে?”
কিন্তু ভেতরে রিপনের সাথে ধস্তাধস্তি চলছে অসিনের।
এক পর্যায়ে অর্ধনগ্ন অসিন কোনোমতে দরজা খুলে এক ছুটে নিজেদের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
অমিতের ছোটো মস্তিস্কে এই ব্যাপারটা ঢুকলো না, কেন অসিনের গায়ে সব জামাকাপড় নেই!

কেইস ৩
বড় মামার বাসায় বেড়াতে এসেছে তুলতুলরা। বড় মামা রাশভারী লোক। কিন্তু মামী খুব মজার। মামাতো ভাই-বোনগুলোও সমবয়সী হওয়ায় তুলতুলের পোয়া বারো।
কিন্তু একটা কারণেই তুলতুলের এখানে আসতে ইচ্ছা করে না। মামা হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেনো করেন। তুলতুলকে নিয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প করেন। সবার চোখে নির্দোষ আচরণ। সবাই ভাবে, মামাতে-ভাগ্নিতে কতো না ভালোবাসা! কিন্তু তুলতুল জানে, মামা তখন ওর হাত নিয়ে নিজের নিম্নাঙ্গ দলাদলি করেন।

এবারও নিঝুম দুপুরে মামা ডাক দিলেন তুলতুলকে। মামাতো বোনের সাথে ও লুডু খেলছিলো। মামার ডাকে আতংকিত তুলতুল শক্ত হয়ে বসে রইলো। মামা দ্বিতীয়বার ডাক দিলেন। এই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠ অমান্য করার সাহস কারো নেই। কিন্তু তুলতুল আজ সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “আমি যাবো না!”

কেইস ৪
মালতী কিছুতেই তার বাচ্চা মেয়েটিকে মুরুব্বীর কোলে বসার জন্য রাজী করাতে পারছেন না। বাসের ভীড়ে নিজে দাঁড়িয়ে আছেন, ঠিক আছে। কিন্তু আট-নয় বছরের মেয়েও দাঁড়িয়ে থাকবে, তা কি হয়? কিন্তু মেয়ে কিছুতেই পাশের সিটে বসা মুরুব্বীর কোলে বসবে না।
কেনো বসবে না? কারণ জানার জন্য আমাদের তাকাতে হবে আরও কয়েকমাস পূর্বের এক ঘটনায়। সেদিনও এমন ভীড়ের মধ্যে মালতী দাঁড়িয়ে ছিলেন আর মেয়েকে বসিয়ে দিয়েছিলেন এক মধ্যবয়স্ক লোকের কোলে।
নানান কথা জিজ্ঞেস করে ভাব জমানোর তালে তালে লোকটা কি করছিলো, সেটা নিশ্চয় বুঝে গেছেন? বাস ভর্তি মানুষের সামনে, এমনকি মেয়েটির মায়ের সামনেই নিখুঁত দক্ষতায় লোকটা নিজের পাশবিক চাহিদা পূরণ করে নিচ্ছিলো। মালতী খেয়াল করেন নি। কারণ তিনি কল্পনাও করেন নি এমন কিছু ঘটতে পারে।

উপরের প্রতিটা ঘটনাই সত্য।  যৌন নিপীড়নের আরও অনেক কায়দা আছে। আরও অনেকভাবে এই বিকৃত মানসিকতা শিশুদের সহ্য করতে হয়। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টা হলো, এগুলোর বেশীরভাগই শুরু হয় পরিবার থেকে। ৯৮% ক্ষেত্রে একটা শিশু প্রথম যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার আপনজনদের কাছ থেকে। এটা শুধু আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য, তা নয়। পৃথিবীর সব দেশেই এটি একটি নিয়মিত ঘটনা।

যেহেতু শিশুরা (বিশেষতঃ মেয়ে শিশুরা) ঘরের বাইরে বেশ কমই বের হয়, তাই বাইরের মানুষের দ্বারা নির্যাতিত হওয়াটা এতোখানি কমন কেইস নয়। কিন্তু বাবা-মা-ভাই-বোন ব্যতীত পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারা (এর মধ্যে মামা, খালু, চাচা, দাদু, কাজিন অন্তর্গত) নিভৃতে নিপীড়নের শিকার হওয়াটা খুবই কমন ব্যাপার। এরপর আসে প্রতিবেশী এবং গণ্ডীর বাইরের মানুষ। এখন অবশ্য বিকৃতির সর্বোচ্চ পর্যায় হিসেবে বাবার দ্বারা মেয়ের রেপড হওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।

আমাদের বাবা-মায়েরা কতোটুকু অসচেতন কিংবা উদাসীন হলে এইসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান নাই, অবাক লাগে! আমি আজকালকার বাবা-মায়েদের দেখেছি (প্রধানতঃ মায়েদের, কারণ ছোটবেলায় তারাই ছিলেন মূল ভুক্তভোগী), তারা সন্তানকে অন্যের হেফাজতে রেখে যাওয়াটাকে নিরাপদ মনে করছেন না। একান্তই রেখে যেতে হলে কোনো মহিলার কাছে রেখে যাচ্ছেন, পুরুষের কাছে নয়। কারণ, বিকৃত পুরুষের কাছে শিশু/প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ব্যাপার নয়। আর কোন পুরুষটা বিকৃত মানসিকতার, সেটা জানা সহজ নয়। তাই না রাখাই শ্রেয়।

একটা শিশু যখন এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, প্রথমে সে বুঝতে পারে না, কী ঘটছে। কারণ এই বয়সে যৌনতা সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকাটা কমন বিষয় নয়। কিন্তু কিছুদিন পর ওরা ঠিকই বুঝে, ব্যাপারটা যাই হোক, উচিৎ কিছু নয়।
একটু জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নিজের জেনিটাল সম্পর্কে সব শিশুর কম বেশী ধারণা হয়ে যায়। এটাও বোঝা হয় যে, এগুলো গোপন জিনিস। ঢেকে রাখার জিনিস। কাউকে দেখানোর মতো তো নয়ই, ধরতে দেওয়ারও নয়। তাই যখন কেউ এসব জায়গায় স্পর্শ করে, শিশুটি বুঝে ফেলে কাজটা ঠিক নয়। ফলে তার মনে আতংকের সৃষ্টি হয়। বারবার একই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে থাকলে এক পর্যায়ে ভয়, লজ্জা আর ঘৃণা জন্ম নেয়। ঐ মানুষগুলোর প্রতি তো বটেই… নিজের প্রতিও। কখনো কখনো এই ঘৃণা স্থায়ী হয় সারাজীবন।

এখনকার মনোবিজ্ঞান বলে, শিশুদের মন অনেক জটিল। যদিও আমরা ভাবি, ওরা অনেক কিছুই বোঝে না। কিন্তু সঠিক তথ্য হচ্ছে, ওরা অনেক কিছু বোঝে। সেই সূত্রে এসব ব্যাপারও শিশুদের মনে বিরাট ছাপ ফেলে যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় পরবর্তীতে। কেইস ৩ আর ৪ এর মতো শিশুরা মানুষদের এড়িয়ে চলতে শেখে। কারো কারো মনে এতো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে যে, তারা জীবনের অধিকাংশ সময়ই ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে পার করে দেয়। পুরুষ জাতির উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়। সব পুরুষকেই মনে হতে থাকে বিকৃত রুচির। এই ধরণের ভুক্তভোগীরা, পুরুষ আছে এমন কোথাও গিয়ে শান্তি পায় না।

অনেককে দেখেছি যারা এসবের শিকার হয়ে সবসময় নিজেকেই দুষেছে, “কেনো মেয়ে হয়ে জন্মালাম?” ছোটবেলার স্মৃতিগুলো দগদগে ঘা হয়ে জ্বলতে থাকে ওদের মনে। কাউকে বলতে শুনেছি, “ঐ পশুগুলো আমাকে অপবিত্র করে দিয়েছে” কিংবা “আমাকে ব্যবহার করেছে”। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, যখন ঐ মানুষগুলোকে চোখের সামনে ঘুরতে দেখা যায়। বেশীরভাগ পুরুষই হয়তো মনে করে, “ছোটবেলার কাহিনী। এখনো কি মনে আছে নাকি ওর?” কিন্তু যেটা সত্যি সেটা হলো, এসব ব্যাপার কখনো ভোলা যায় না।

সবশেষে এটাই বলতে চাই, এখন আমরা অনেক সচেতন। কীভাবে একটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, কাদের দ্বারা এসব ঘটে কিংবা কোন পরিস্থিতিতে এসব ঘটতে পারে – আমরা জানি। তাই নিজেদের সন্তানকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই।
আমাদের সন্তানরা যেনো কখনো তাদের জীবনে যৌন নিপীড়নের মতো দগদগে ঘা তৈরীর ব্যাপারে আমাদের অজ্ঞতা, গাফিলতি কিংবা অবহেলাকে দোষ দিতে না পারে।

দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায়, আমাদের দেশের ৬.৬% ছেলে এবং ১৫.৩% মেয়েশিশু যৌন হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হয় তাদের পরিবারের বন্ধু, শিক্ষক, আত্মীয় ও পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা।

শুধু যে মেয়েরাই এর শিকার তা নয়, ছেলেরাও এ ধরণের ঘটনার শিকার হচ্ছে অহরহ। অ্যাকশন এইড- নিরাপদ নগর কর্মসূচির এক জরিপে দেখা যায়, আমাদের দেশের ৮৪ শতাংশ নারী যারা এরকম হয়রানি কিংবা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা আত্মসম্মান এবং সামাজিক অপবাদের কথা চিন্তা করে কাউকে কিছু জানান না।

এই ধরণের হয়রানি এবং নির্যাতন রোধ করতে হলে প্রথমেই যেটা প্রয়োজন সেটা হল পরিবারের বন্ধুসুলভ আচরণ। কেননা বাবা-মা তার সন্তানের সাথে খোলামেলা না হতে পারলে সন্তানেরা তাদের সমস্যা এবং তাদের সাথে ঘটে যাওয়া এরকম ঘটনা নিয়ে সরাসরি কথা বলতে পারবে না। বন্ধুর মতো তার সন্তানের সকল কিছুকে জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা এরকম ঘটনা শিশুদের জীবনে অনেক গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।

Spread the love
%d bloggers like this: