জয়কে হত্যার মামলায় মাহমুদুর রহমান কারাগারে
সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্রের’ মামলায় বন্ধ হওয়া যাওয়া আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রোববার শুনানি শেষে এ আদেশ দেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মাহাবুবুল হক। এদিন মাহমুদুর রহমান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
শুনানিতে তার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, “এই মামলা কার জন্য, কখন করা হয়েছে-এটা আমরা নাই বললাম। এ মামলাটির ঘটনা ঘটেছে আমেরিকায়। সেখানকার আইনব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী, সেটা আমরা জানি।
“কারসাজি করে মামলার ঘটনাটি বাংলাদেশে দেখিয়ে একটি সাজানো মামলা দেওয়া হয়েছে। সেই মামলায় মাহমুদুর রহমান সাহেবকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১২৩ ধারায় তাকে আরো দুই বছরের সাজা দেয়া হয়েছে, যেটা সহযোগী হিসেবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমানসহ আরো দুজনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “মাহমুদুর রহমান আইনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তিনি বিদেশে ছিলেন, আইন মান্য করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি আইনের প্রতি এতই শ্রদ্ধাশীল- তিনি যখন কারাগার থেকে আদালতে আসতেন, তিনি বিশেষ সুবিধায় গাড়ি না নিয়ে সাধারণ প্রিজন ভ্যানে করেই আদালতে আসতেন।
“আমরা বিনীত আবেদন করব, আমরা আপিল করার জন্য প্রয়োজনীয় সই মুহুরির নকল যেন দ্রুত পেতে পারি- তার জন্য বিজ্ঞ আদালত দয়া করে একটি আদেশ দেবেন। এছাড়া কারাবিধি অনুসারে তিনি যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী, আমি আবেদন করব তাকে যেন সে সুবিধাগুলো দেওয়া হয়।”
তিনি আসামির প্রথম শ্রেণির ডিভিশন দেওয়ার নির্দেশনা চাইলে বিচারক কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
মাহমুদুর রহমান নিয়োজিত আইনজীবী সৈয়দ মো. জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, “মোট সাজার পরিমাণ ৭ বছর হওয়ায় এই আদালত আপিলের শর্তে জামিন দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন না বিধায় আমরা জামিনের আবেদন করিনি।
“আমরা শুধুমাত্র আত্মসমর্পণ ও ডিভিশনের আবেদন করেছি। ডিভিশনের বিষয়ে কারাবিধি অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত।”
শুনানি শুরুর আগে এজলাস কক্ষ থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন মাহমুদুর রহমান।
তিনি বলেন, “আমি কোনো দলের হয়ে কখনো লড়াই করিনি। আমি অতীতে যেমন ন্যায়ের জন্য লড়াই করে গেছি, এই ন্যায়ের লড়াই অব্যাহত থাকবে। আমি ন্যায়ের জন্য লড়াই করে যাব।”
এ মামলায় গত বছরের ১৭ আগস্ট মাহমুদুর রহমান, যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমান, জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন, তার ছেলে রিজভী আহাম্মেদ ওরফে সিজার এবং যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ভূঁইয়াকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় আদালত।
মামলা বৃত্তান্ত
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মামুন বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাসাসের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি এবং যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সহ-সভাপতি ছিলেন। পরিবার নিয়ে কানেটিকাটের ফেয়ারফিল্ড কাউন্টিতে বসবাস করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়। তার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত গোপন তথ্য পেতে এফবিআইএর এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার অপরাধে ২০১৫ সালের ৪ মার্চ মামুনের ছেলে রিজভী আহমেদ সিজারকে সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় নিউ ইয়র্কের একটি আদালত।
ওই রায়ের পর জয়কে অপহরণের চক্রান্তের অভিযোগে ২০১৫ সালের ৩ অগাস্ট গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৭ ও ১২০ (বি) ধারায় ঢাকার পল্টন থানায় এই মামলা দায়ের করেন।
সেখানে বলা হয়, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আগে মামুনসহ বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত অন্যান্য দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা রাজধানীর পল্টনের জাসাস কার্যালয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার একত্রিত হয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।
তদন্ত শেষে গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হাসান আরাফাত ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
সেখানে জয়কে অপহরণ করে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়। আর আসামি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের বিরুদ্ধে আনা হয় পরামর্শদাতা হিসেবে ওই ষড়যন্ত্রে সহযোগিতার অভিযোগ।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মামুনের ছেলে রিজভী আহাম্মেদ যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের কাছ থেকে সজীব ওয়াজেদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেন এবং পরে তা অন্য আসামিদের সরবরাহ করেন। আর প্রবাসী ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান এই ষড়যন্ত্রে অর্থ যোগানোর পাশাপাশি পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
গোয়েন্দা পুলিশ এ অভিযোগপত্র দিলে পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে আদালত। সজীব ওয়াজেদ জয়ও ২০২২ সালের নভেম্বরে আদালতে গিয়ে এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।
এরপর গত বছরের ১৭ অগাস্ট আসামিদের অনুপস্থিতিতে বিচারক রায় ঘোষণা করেন। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়।
নির্বাসিত জীবন ছেড়ে দেশে ফেরা
খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহের এক মামলায় ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকার কারওয়ান বাজারে আমার দেশ কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার হন। পরে কারাবান্দি অবস্থায় ২০১৬ সালের এপ্রিলে তাকে জয়কে অপহরণ ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
সাড়ে তিন বছর জেলে থাকার পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে মাহমুদুর রহমান জামিনে মুক্তি পান। পরে তিনি লন্ডনে চলে যান। সাড়ে ৫ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে গত শুক্রবার তিনি দেশে ফেরেন।
আরেক সাংবাদিক শফিক রেহমানকে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ইস্কাটনের বাসা থেকে গ্রেপ্তারের পর জয়কে অপহরণ ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সে সময় দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বিএনপিঘনিষ্ঠ এই সম্পাদককে।
পাঁচ মাস কারাগারে থাকার পর সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে মুক্তি পান যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক। পরে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১৮ অগাস্ট তিনি দেশে ফেরেন।